মার্চেন্ট অব ডেথ
১৮৮৮ সাল। এক ফ্রেঞ্চ পত্রিকায় শিরোনাম এলো, ‘le marchand de la mort est mort’
বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘মৃত্যু ব্যবসায়ীর মৃত্যু’। সমস্ত দুনিয়া যেনো স্বস্তি পেয়েছে। অথচ যার ব্যাপারে লিখা হয়, তিনি কিন্তু তখনও ঘাপটি মেরে বেঁচে। এসব দেখে প্রচন্ড ব্যথিত হৃদয়ে জীবন সমীকরণ মেলাচ্ছেন। কিন্তু যা হবার, ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। ডায়নামাইট..
হ্যাঁ, বলছি সমাজের চোখে অত্যন্ত সফল, বিজনেস টাইকুন আলফ্রেড নোবেলের কথা। বোমা, বারুদ, মারণাস্ত্র নিয়েই ছিলো যার কারবার। যুদ্ধ লাগলেই ফুলে ফেঁপে উঠতো যার ব্যবসা। যুদ্ধবিরোধী হয়েও বিস্ফোরক গবেষণা ছিলো যার অনন্ত নেশা। ফলাফল?
ভয়াবহ বিস্ফোরক নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে এক অদম্য খেলায় মেতে উঠেছিলেন আলফ্রেড নোবেল। হঠাৎ বিস্ফোরণ!
চোখের সামনেই পুড়ে মরে আপন ছোট ভাই এমিল সহ পাচঁ জন কর্মী। নোবেল তবুও পরীক্ষা চালিয়ে যান। তৈরি করেন আরেকটি কারখানা। গবেষণায় তখন বেশ উন্নতি। এরপরেও আবার এক ভয়ানক বিস্ফোরণ!
সে কারখানাটিও ধ্বংস হয়ে যায়। আহত হন তিনি নিজেও।
এমন একের পর এক ধ্বংসেও নোবেল থেমে যান নি। নাইট্রোগ্লিসারিনের আবিষ্কারক নিজেও বার বার সতর্ক করেন। তবুও তিনি থামেননি। নদীতে ভেলা ভাসিয়ে তাতে নাইট্রোগ্লিসারিন বিস্ফোরককে আরও নিরাপদ করার চেষ্টা চালিয়ে যান। এ সময়ই আবিষ্কার করেন এক নতুন মিশ্র বিস্ফোরক, ডায়নামাইট। কল্যাণের উদ্দেশ্যে এ আবিষ্কার হলেও, ফলাফল আমরা সবাই জানি।
খেয়াল করুন, এই আলফ্রেড নোবেল কিন্তু জানতেন, তার নেশা বড় ধ্বংসাত্মক। তবুও তিনি দুনিয়াবি ব্যবসায় লাভের পেছনে ছুটেছেন বারবার। ভালো করে কখনো চিন্তাই করেননি, এর ভবিষ্যৎ কি হতে পারে। শেষমেষ ফ্রেঞ্চ সাংবাদিকের লিখায় যখন তার বোধোদয় হয়, তখন অনেকটা দেরি।
আদতে আমরা প্রায় সবাই এই নোবেল সাহেবের মতো নেশাগ্রস্ত। আমাদের প্রায় প্রতিটা কাজই নেশা। সবাই জানি, মরবোই। মরার পর সমস্ত জারিজুরি শেষ। যতোই দুনিয়াতে লাফালাফি করুক, কেউ কি এসব সত্যি অস্বীকার করতে পারবে?
না। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ কালের স্রোতে বয়ে চলে। নিজেকে নিয়ে বা চারপাশের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ে চিন্তা করতে পারে না। পৃথিবীর এতো এতো ধোঁকার সামগ্রীর মাঝে নিজের গন্তব্য নিয়ে গভীরভাবে ভাবার চেষ্টাও করে না।
খেয়াল করবেন, আপনি যদি নাটক, সিনেমা, গানসহ বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের খারাপ দিকগুলি তুলে ধরেন, তারা বলবে- এভাবে তো ভেবে দেখিনি, কিংবা এতো চিন্তা করলে চলে না আসলে।
অথচ এই ‘চিন্তা’ একটা মানুষের জন্য সবচেয়ে জরুরি। কোরআনে বার বার বলা হয়েছে চিন্তা করতে। বলা হয়েছে –
তোমরা খুব কমই চিন্তা-ভাবনা করে থাকো। (সূরাহ্ আল-হাক্বাহ্ঃ ৪২)
গভীরভাবে চিন্তা করার ক্ষমতার জন্যেই কিন্তু আমরা মানুষ। চিন্তা করলেই কেবল মানুষ ঠিক ভুলের পার্থক্য বুঝতে পারবে। চিন্তা হতে হবে নিজস্ব। অধিকাংশ করছে বলে বা লোকে কি বলবে, এ ধরণের সংকীর্ণ চিন্তা নয়।
সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা ছাড়াই রোজ রোজ অশ্লীলতা, সুদ, ঘুষ, নিত্যনতুন ট্রেন্ডের পেছনে ছুটছি আমরা। ভালো করে ভাবলে মনের গহীনে সবাই অনুভব করবো, এসব ভালো কিছুই এনে দেবে না শেষমেষ। কিন্তু এই যে ‘চিন্তা’, এটা করতে গেলেই আমাদের মাথায় চাপ পড়ে যায়। কারণ, চারপাশের বিভিন্ন ধোকার উপকরণে আমরা নেশাগ্রস্ত হয়ে গেছি। নিশ্চিত ধ্বংস জেনেও তা থেকে ফেরার কথা ভাবতে পারি না। বার বার নানাভাবে আমাদের সতর্ক করা হয়, তবুও আমরা ফিরতে পারি না।
মজার ব্যাপার কি জানেন? আলফ্রেড নোবেল ছিলেন হৃদরোগে আক্রান্ত। তিনি জানতেন না, যে নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে আজীবন বিস্ফোরক আবিষ্কারের নেশায় মত্ত ছিলেন, সেই নাইট্রোগ্লিসারিনই ছিল তার হৃদরোগের ওষুধ। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা সেই নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে গবেষণা করেই আবিষ্কার করেন এর দ্রুত উপশমকারী ওষুধ নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে, যা তীব্র হার্টের ব্যথা হলে জিহ্বার নিচে স্প্রে করা হয়।
সারাজীবন নিজের ওষুধ নিয়ে নাড়াচাড়া করেও সেখান থেকে টেনে আনলেন ধ্বংস আর মৃত্যু। শেষমেষ হৃদরোগেই সমস্ত মিথ্যে নেশা আর দুনিয়ার মস্ত বাণিজ্য ছেড়ে নিঃসঙ্গ নোবেল পারি জমান ওপারে। যেখানে আছে অনন্তকাল…
_______________
মার্চেন্ট অব ডেথ
জান্নাত মিম